কথা রাখলেন প্রধানমন্ত্রী

পেশাগতকারণে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ তিন বছর প্রয়াত মেয়র নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। প্রায় সময়ে আমি চশমা হিলের বাসায় না হয় জিইসিস্থ প্রিমিয়ার ইউনিভার্সটিতে যেতাম। বেশিরভাগ সময় আমি নিজ গরজে গেলেও আবার অনেক সময় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অভিভাবক আমরা যাকে হুজুর বলে সম্বোধন করতাম সেই হুজুরই ডাক দিতেন। হয়তো কখনো নগর ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি নুরুল আজিম রনির মাধ্যমে আবার না হয় হুজুরের এপিস ওসমান গণির মাধ্যমে।

এরকম কত বার রাত কিংবা দুপুরের খাবার খেয়েছি হুজুরের সাথে তার হিসাব নেই। শত শত দর্শনার্থীর সাক্ষাৎ-ব্যস্ততার মাঝেও চেষ্টা করতেন সবাইকে সময় দিতে। আমার সাথেও নিউজের পাশাপাশি সম সাময়িক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন! যতটুকু সময় পেতেন।

সময়টা ২০১৬ সালের দিকে হবে। ছাত্রলীগ নেতা রনির ফোন পেয়ে হুজুরের ডাকে রাতে হাজির হলাম চশমা হিলের বাসায়। সালাম বিনিময়ের পর রাতের খাবারও খেলাম একসাথে। তারপর সকলে নিজ নিজ গন্ত্যবে চলে গেলেও আমাকে বসতে বললেন। অফার করলেন গরুর দুধের চা পানের! আমিও অফারটি লুপে নিলাম। চা পানের সাথে চলতে থাকে ছোট্ট ছোট্ট আলাপ।

অনেক কথার মাঝে দুটি কথাই আমার কাছে এখনো মনে অাছে। একটি হলো ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেলের বড় মেয়েকে কদিন আগে দেখতে গেছেন ঢাকা। নাতিনিকে দেখতে গিয়ে দাদা উপহার দিবেন বলে স্থির করলেন। রাজধানীর বায়তুল মোকারমের স্বর্ণের এক দোকানে নিজের বডি গার্ড পাঠিয়ে এক জোড়া স্বর্ণের বালা নিলেন নাতনির জন্য। তিনি গাড়িতে বসে ছিলেন। দাম আসলো প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। তখন স্বর্ণের উচ্চমূল্য। জুয়েলার্স ম্যানেজার যখন ক্রেতার নাম জানতে চাইলেন তখন বডিগার্ড বললেন, ক্রেতার নাম- এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। একথা শুনে ম্যানেজারের চোখ কপালে! তিনি বিস্মিত হয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত স্টাফের কাছে জানতে চান এ মহিউদ্দিন চৌধুরী কি চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী? প্রতি উত্তরে জানতে পারলেন। হ্যাঁ উনিই চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরী!

বিস্ময়ের ঘোর দ্রুতই কেটে গেলো ম্যানেজারের। বললেন, আমি উনাকে দেখব! সালাম দেব! একটু মোলাকাত করব! তখন নিজেই ওই ম্যানেজার নীচে নেমে আসলেন গাড়িতে বসে থাকা চট্টলবীরের কাছে। এসেই সালাম দিয়ে নিজের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, লিডার আমি আপনার অনেক কথা শুনেছি কিন্তু কোনো দিন সামনা-সামনি দেখিনি। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলনা আপনিই আমার দোকানের কাস্টমার। তাই আপনাকে দেখতে এসেছি। একটু দেকোনে আসেন কষ্ট করে। মিষ্টি মুখ করুন। এসময় মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজের ডায়াবেটিক রোগের কথা তাকে জানান আর শারিরীকভাবে অসুস্থ সেটিও বলেন ওই ম্যানেজারকে।

তখন ম্যানেজার নিজ থেকেই বললেন স্যার আমি খুশি হয়ে আপনাকে সম্মান জানিয়ে দুই জোড়া বালার দাম ১ লাখ বিশ হাজার টাকা হলেও বিশ হাজার টাকা ডিসকাউন্ট করতে চাই। আমাকে আপনার প্রতি এ সম্মানটুকু করার সুযোগ দিন। পরে এই আবদারে সম্মতি দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এরপর জানতে চাইলাম ঢাকায় নাতনির কাছে গেলেন সেই গল্প শুনালেন। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) কাছে গেছেন শুনলাম এবার সেই গল্প শুনতে চাই! তখন হুজুর বলেছেন, সৌজন্য সাক্ষাৎ, তেমন কিছুই হয়নি। দুজন দুজনের শারিরিক খোঁজ খবর নিলাম। নগর আওয়ামী লীগকে দেখে রাখতে বলেছেন নেত্রী। আর বলেছেন, আপনি আছেন বলেই আমি অনেকটা নির্ভার চট্টগ্রাম নিয়ে এসব বলেছেন।

আমার কৌতূহলী মন অারো কিছু জানতে চাই হুজুরের কাছ থেকে। হুজুর কিন্তু কথা পেট থেকে বের করতে চান না! এরপরও নানা কথার ফাঁকে বললেন আরেকটি দামি কথা। বলেছেন, নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় তার বড় পুত্র মহিবুল হাসান নওফেলও ছিলেন। এসময় নেত্রী বলেছেন, মহিউদ্দিন ভাই আপনি নওফেলকে দেখে রাখবেন! আমি তাকে আগামী নির্বাচনে কোতোয়ালী থেকে নির্বাচন করাব! তখন আমি বলেছি আপনি যেটা ভালো মনে করেন। এসময় মহিউদ্দিন চৌধুরী বলে ফেলেন, আমার চেয়ে নেত্রীর সঙ্গে ব্যারিস্টার সাহেবের সম্পর্ক ভালো! তাকে খুব পছন্দ করেন নেত্রী!

এই কথাটি আমি অনেককে বলেছি তাঁর জীবদ্দশায় আর মৃত্যুর পরও। নেত্রী নাকি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বলেছেন তার পুত্র মহিবুল হাসান নওফেলকে কোতোয়ালী থেকে নির্বাচন করাবেন। জোট মহাজোটের সমীকরণে যখন জাপার বর্তমান এমপি জিয়া উদ্দীন বাবলুর মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত তখনো আমি বলছি, নেত্রী বলেছিলেন হয়তো জোটের সমীকরণে পারছেন নাহ! তবে নওফেলকে দলের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক করেছেন। আগামীতে আরো বড় দায়িত্ব দিবেন।

জোটের সমীকরণে দলের মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেননি নওফেল। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের আগ্রহে দ্বিতীয় দিন দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়ে পরে ওবায়দুল কাদেরের কাছে জমা দেন নওফেল। এরপরও তাঁর অনুসারীরা অনিশ্চয়তার দোলাচলে ছিলেন শুধুমাত্র মহাজোটের হেভিওয়েট প্রার্থী জিয়াউদ্দিন বাবলুর কারণে। কিন্তু গতকাল (শনিবার) রাতেই সভানেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহেই বাবলুকে সরিয়ে নওফেলকে কোতোয়ালী থেকে প্রার্থী করা হয়।

যেখানে আওয়ামী লীগের মত দলের তিনশ আসনের বিপরীতে মনোনয়নের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মনোনয়ন ফরম নেয়া হয় সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি আসনে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আগ্রহে প্রার্থী হওয়া নিসন্দেহে বড় প্রাপ্তি! এর মধ্য দিয়ে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণকারী যাওয়া চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দেওয়া কথাটাই রাখলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। কেননা, এরআগে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার বাসায় শোকাহত পরিবারকে দেখতে এসেছিলেন তিনি। ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখতেন প্রধানমন্ত্রী।

লেখক : সাংবাদিক